রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৩ অপরাহ্ন
কালের খবর :বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান দুই দুর্নীতির মামলায় নেতিবাচক কিছু হওয়ার আশঙ্কায় রায়ের আগেই হার্ডলাইনে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।
সরকারকে সতর্ক করে ‘আন্দোলনের হুমকি’ দিয়ে তারা বলছেন, রায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গেলে এর প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ। মামলাকে রাজনৈতিকভাবেও মোকাবিলা করার কথাও বলছেন তারা।
দলটির নেতাদের অভিযোগ, বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে ষড়যন্ত্র করে সরকার দুর্নীতির মামলাকে ব্যবহার করতে চাইছে।
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের মামলার রায় ঘোষণা করবে ঢাকার পঞ্চম জজ আদালত। জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের দায়েরকৃত আলোচিত মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান রায়ের দিন আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ঠিক করেন।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে এ মামলায় তার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানও এ মামলার আসামি। মুদ্রা পাচারের দায়ে সাত বছর কারাদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। এ মামলাতেও তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
যদিও খালেদার আইনজীবী রেজাক খান বলেছেন, ‘এটি একটি অসার মামলা। খালেদা জিয়া খালাস পাবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। এ মামলা সারহীন। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আসামিপক্ষের অধিকাংশ যুক্তিও খণ্ডন করতে পারেনি।’
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়ার মামলার রায়ে নেতিবাচক কিছু হলে দলটি কোন পথে হাঁটবে, সে বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য শনিবার রাতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেছেন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকটিকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন দলটির সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। মূলত বৈঠকের পরই সিদ্ধান্ত হবে কোন পথে হাঁটবে বিএনপি।
যদিও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতি মামলায় ‘নেতিবাচক কোনো কিছু’ হওয়ার আশঙ্কা করছেন দলটির নেতারা।
‘ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া’ হবে জানিয়ে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, খালেদা জিয়ার প্রতি ‘নিয়ন্ত্রিত আদালত’ কর্তৃক শেখ হাসিনা যদি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চান তাহলে তার জবাব তিনি পাবেন।
‘৮ ফেব্রুয়ারি নিয়ে যেটা আমরা আশঙ্কা করছি, নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে যদি আদালত থেকে প্রকাশ পায়, তাহলে গণতন্ত্রবিহীন বর্তমান সরকারের পতনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হবে। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু করার ঘোষণা দিই বা না দিই, এমন কিছু যে ঘটবে না- সে নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না’, বলেন তিনি।
রায়ের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি ‘ফয়সালার দিন’ আখ্যায়িত করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গায়ে যদি ফুলের আঁচড়ও পড়ে বাংলাদেশের মানুষ গর্জে উঠবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) এবং এরশাদ (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) বেগম জিয়াকে জেলে নিতে চান, দেশবাসী সেটা জানে। তাদের এই আক্রোশ দেশবাসী মানবে না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার মামলায় রায়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ায় নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘দেশনেত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এতদিন আমরা আইনিভাবে মোকাবিলা করেছি। আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, যদি এই মিথ্যা, বানোয়াট ও পাতানো মামলাকে কেন্দ্র করে আমাদের নেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে আমরা তা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করব।’
‘সামনে সেই ডাক আসবে। আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক আসবে, সেই ডাকে আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে সাড়া দেবেন, এই প্রত্যাশা আমি করছি’, নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন মোশাররফ।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘এই মামলার সঙ্গে তার (খালেদা জিয়া) কোনোপ্রকার সম্পৃক্ততা নেই। কুয়েতের আমির ট্রাস্টে টাকা সরাসরি দান করেছিলেন, এটা প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ ফান্ডে আসে না। তারপরও গায়ের জোরে উনার বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে গেছে।’
‘একটাই উদ্দেশ্য- ২০১৪ সালের মতো আবার সেইভাবে ভোটছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকতে দেশনেত্রীসহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে নির্বাচনে বাইরে রাখা।’
মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার রায় হলে বাংলাদেশে ‘প্রলয়কাণ্ড’ ঘটবে বলে হুঁশিয়ারি দেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন আপনি (প্রধানমন্ত্রী) ৩০/৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করছেন, তারপরও শক্তিতে কমে না। নিজের বুকের শার্ট খুলে বুক চিতিয়ে যারা গ্রেপ্তার বরণ করতে পারে, তারা বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে অশুভ কিছু হলে এই দেশে প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে দেবে। দেশে তুমুল ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবে।’
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘিরে কেউ ‘বিশৃঙ্খলা বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের’ চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ নেবে বলে হুঁশিয়ার দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রায় ঘোষণার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘হুঁশিয়ারিমূলক’ আগাম বক্তব্য ‘সঙ্গত নয়’।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো রায়টা পাইনি। আইনগতভাবে নীতিগতভাবে রায় ঘোষণা হওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া সেইভাবে বলতে পারব না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে আজকে কথা বলেছেন। এই কথা বলা কোনো মতেই সঙ্গত নয়। তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। এ থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়, তারা কী চিন্তা করছেন?’
খালেদা জিয়ার মামলার রায় ‘দ্রুততার সাথে করানো হচ্ছে’ অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নজিরবিহীন তাড়াহুড়ার মধ্যে দ্রুততার সাথে এই মামলা শেষ করার চেষ্টা হচ্ছে। দেশনেত্রীর আইনজীবীরা পরিষ্কার করে বলেছেন, জাস্টিস হারিড ইজ জাস্টিস বারিড।’
‘কারণ তারা (ক্ষমতাসীন) কর্ণপাত করছেন না। তারা ডিটারমিন্ড যে, তারা আগামী নির্বাচন করতে চান বিএনপিকে বাদ দিয়ে এবং সেজন্যই তাড়াহুড়া করে বিচার কাজ শেষ করা এবং এসব কমেন্ট করা। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করিনি।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘অনেকদিন আগে থেকেই সরকারের লোকজন এই মামলা নিয়ে আগাম বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বহু আগেই রায় দিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় মনে আছে অনেক আগেই তিনি বলে দিয়েছিলেন এতিমের টাকার ব্যাপারে। অন্যান্য মন্ত্রীরা বলছেন। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ তারা হুমকি দিয়েছেন, তারা শক্তি প্রয়োগ করেছেন, বলপ্রয়োগ করেছেন।’
‘কয়েকদিন আগে এরশাদ সাহেব রংপুরে বলেছেন, আর মাত্র কয়েকদিন তারপর যেতে হবে জেলে। তার দলের একজন প্রতিমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন। রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের এ ধরনের কথা দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয়, আগাম বলে দেওয়া- রায় পূর্বনির্ধারিত, পরিকল্পিত। দ্য আর প্রিপিয়ার্ড ফর এভরিথিং’, বলেন মির্জা ফখরুল।